ইজমা ও কিয়াস : স্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরী
রহমান রহিম আল্লাহ্ তা'আলার নামে
ইজমা ও কিয়াস নিয়ে আমাদের সমাজে ব্যপক ভুল ধারণা বিদ্যমান। আমরা জানিই না ইজমা কি আর কিয়াস কি!
মানুষ ইজমা কিয়াস সম্পর্কে মারাত্মক ভুল জ্ঞান রাখার কারণে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় ধর্মের মধ্যে ইজমা কিয়াসের নাম দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিদাতি খুবই অল্প জ্ঞানী সুফিবাদী আলেম নাম ধারী লোকেরা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের কাছে নতুন নতুন বিষয় উপস্থাপন করে বলেন এটা ইজমা হয়ে গিয়েছে ওটা কিয়াস হয়ে গিয়েছে। আর সাধারণ মানুষও না বুঝেই সেগুলো গ্রহণ করেছে এবং সহিহ বিষয় উপস্থাপন হলে উনারা সেটা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইজমা কিয়াসের যুক্তি দাড় করান অথচ তিনি জানেনই না ইজমা কি বা কিয়াস কি!
আল্লাহ্ সুবহানওয়া বলেন:
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (মায়েদা, ৫ : ৩);
‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর ।’ (নিসা, আয়াত ৫৯);
'সে লোক ইমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে [রাসুল স] ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে ।’ (নিসা, আয়াত ৬৫)
আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসুলের (ইমরান, আয়াত ৩২, ১৩২; নিসা, আয়াত ৫৯; আনফাল, আয়াত ১, ২০, ৪৬; নুর, আয়াত ৫৪, ৫৬; মুহাম্মদ, আয়াত ৩৩; মুজাদালাহ, আয়াত ১৩; আততাগাবুন, আয়াত ১২);
'তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তাঁর অনুসরণ করো এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অলী আওলীয়াদের অনুসরণ করো না । তোমরা অল্প সংখ্যক লোকই তা স্মরণ রাখো ।’ (আ’রাফ, আয়াত ৩)
অনেকেই বলে থাকেন কুরআন হাদিসে সমাধান না পাওয়া গেলে কি করব? অথচ স্বয়ং আল্লাহ বলছেন মতানৈক্য হলে রাসুল (সাঃ) ও কুরানের দিকে ফিরে আসতে! অর্থাত কুরআন ও হাদিসের মধ্যেই সমাধান অবশ্যই আছে। তারপরেও যদি বলেন কুরানে ও হাদিসে তো নাই! তাহলে তো আরো সহজ যা কুরআন ও হাদিসে নাই তা ইসলামেও নাই!
‘‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’’ -(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস নং ১৫৬০, হাদীসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে)
ইসলামী শরীয়তের (আইনের) তৃতীয় উৎস হলো ইজমাঃ
——————————————————
ইজমা হলো এ উম্মতের দীনি জ্ঞানসম্পন্ন মুজতাহিদদের ঐকমত্য পোষণ।
আর এর ভিত্তি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহিহ হাদিস- '‘আমার উম্মত কখনও ভ্রষ্ট পথে একমত হবে না’’ । (মুস্তাদরাকে হাকিম (১/২০০-২০১) হাদীস নং- ৩৯৪, ৩৯৬, ৩৯৭, ৩৯৯, ৪০০। আরো দেখুন: আবুদাউদ (৪/৯৮) হাদীস নং- ৪২৫৩; তিরমিজি (৪/৪৬৬) হাদীস নং- ২১৬৭; ইবনে মাজা (২/১৩০৩) হাদীস নং- ৩৯৫০)
সুতরাং উম্মতের সবাই যদি কোনো ব্যাপারে একমত হয়, তাহলে তাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুমতিক্রমেই হবে। আর তা হবে গ্রহণযোগ্য। পূর্ববর্তী কোনো দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদের নবীর মুখ থেকে এরকম কোনো অভয়বাণী শোনানো হয় নি। ফলে তাদের সবাই একমত হলেই সে মতটি সঠিক হওয়ার গ্যারান্টি নেই।
আজকে সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে সহজে বুঝা যায় যে আহলে সুন্নাত জামায়াতের স্কলারগণ অন্যান্য প্রচলিত বিভিন্ন ফেরকার নিজস্ব মতামত গ্রহণ করছেন না। তারা কুরআন ও সহিহ হাদিসের বাইরে কোনো মতামত গ্রহণ করেন না। ব্যক্তিগত কোনো মতামত তারা গ্রহণ করেন না। অতএব ইজমা ইজমা করে যারা নতুন বিষয় দ্বীনে প্রবেশ করাচ্ছেন তারা মূলত ইজমা নিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন।
আজকে সমাজে কিছু সংখ্যক আলেম ইজমা ইজমা করছেন অথচ সালাফি স্কলারগণ রীতিমত তাদের বিরোধিতা করছেন! তাহলে ইজমা হলো কিভাবে?
“যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
অনেক স্কলারদের মতে চার খলিফার পরে উম্মতের মধ্যে ইজমা হওয়ার আর কোনো সুযোগ নাই! ইজমার উদাহরণ হচ্ছে যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পাচ ওয়াক্ত ১৭ রাকাত সালাত ফরজ। এই ফরজ কম করা যাবে না বা বেশিও করা যাবে না। এটাই হচ্ছে ইজমা। কেউ যদি বলে ১৭ রাকাত না ১৮ রাকাত বা ১৯ রাকাত তবে তা গ্রহণ যোগ্য হবে না!
এটাই ইজমা যে ১৭ রাকাত ফরজ সালাত। এটা ১৪৫০ বছর আগে থেকেই প্রকাশিত একটা বিষয়। নতুন বিষয় নয়। কেউ যদি বলে বিতর সালাত ফরজ এটা ইজমা তাহলে এটা ভুল! ফরজ তো অবশ্যই নয়। বিতর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা অর্থাত খুব গুরুত্ত পূর্ণ ঠিক যেমন ফজরের সুন্নত সালাত খুব গুরুত্ব পূর্ণ, যদিও কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন! তবে অধিকাংশ স্কলারদের মতে এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
লক্ষনীয় বিষয় কেউ যদি বলে বিতর ফরজ বা ওয়াজিব এটা ইজমা তাহলে ভুল! উপরের হাদিস লক্ষ্য করেন ”একমত হবে না” অর্থাত অধিকাংশ স্কলার সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন যদিও কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন।
কিন্তু সবাই একমত দৈনিক পাচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ। চার ওয়াক্ত নয় আবার ছয় ওয়াক্তও নয়। এটাই ইজমা।
যাকাত ফরজ এটা ইজমা।
সিয়াম ফরজ এটা ইজমা।
ইসলামী শরীয়তের (আইনের) চতুর্থ উৎস হলো কিয়াস:
—————————————————-
যা নির্ভর করে পূর্ববর্তী তিনটি উৎসের উপর। সুতরাং এটাও মনগড়া কিছু নয়। কিয়াস হচ্ছে কুরআন ও হাদিসকে কেয়ামত পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করা। এটা নতুন কোনো বানানো বিষয় নয়।
এর ছোট্ট একটা উদাহরণ হলো এই কাগজে কুরআন লেখা কি নিষেধ? এখানে কিয়াস হচ্ছে অবশ্যই না। কারণ তত্কালীন সময়ে চামড়ায় গাছের পাতায় বাকলে লেখা হত , যদি কাগজ থাকত তবে কাগজেও লেখা হত।
এই যে ১৪৫০ বছর আগে নাজিল হওয়া কুরআনের বিধান বর্তমান সময়ে সমন্বয় করা এটাই কিয়াস।
বিলাল (রাঃ) কে উচ্চ স্বরে আজান দিতে বলা হত যাতে বেশি দূর পর্যন্ত লোকে আজান শুনতে পায়!। এবং এক অন্ধ লোককে আজান শুনতে পেলে মসজিদে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল । আজান যত বেশি দূর পর্যন্ত পৌছবে তত সয়াব অর্জনের কথা হাদিসে এসেছে। ইসলাম জীবনের প্রয়োজনে নতুন টেকনোলজি ব্যবহার নিষেধ করে না। অতএব বুঝা যাচ্ছে যদি তখন মাইক থাকত তাহলে মাইক ব্যবহার করা হত। মাইক ব্যবহার দ্বীন ইসলামের বিধান পরিবর্তন করে না।
“যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে উহার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে উহার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না”। (মুসলিম)
এই যে সংযোজন অর্থাত কানেক্টিভিটি ১৪৫০ বছর আগের কুরআন ও হাদিসের বাণীর সাথে এটাই হচ্ছে কিয়াস।
অথচ সমাজে দ্বীনের নাম নতুন বিষয় সংযোজন করে বলা হচ্ছে এটা কিয়াস! অথচ দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নতুন সংযোজন বিদাত যা গোমরাহী যার পরিনাম জাহান্নাম।
উদাহরণস্বরূপ:
কিয়াসের নামে কুরআন ও সুন্নাহের বিপরীত কোনো বিষয় গ্রহণ করা কিভাবে সমীচীন হবে?
“যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
একই ভাবে বাসে চড়া বিমানে চড়া, মেশিনে কাপড় সেলাই জায়েজ কিনা , মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা জায়েজ কিনা এগুলো সম্পর্কে মাসাআলা কিয়াসের ভিত্তিতে হয়।
কিন্তু দ্বীন ইসলামের কোনো বিষয়ই হের ফের করার সুযোগ নেই।
অতএব আমরা বুঝতে পারছি যে, ইসলাম এমন একটি দ্বীনের নাম, যা সম্পূর্ণভাবে অবিকৃত রয়েছে। আর তার বিধানসমূহে বাইরের কোনো প্রভাব সেখানে পড়ে নি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলাই এ বিধান দিয়েছেন, আর জ্ঞান-বিজ্ঞানও তাঁর পক্ষ থেকেই দেয়া নেয়ামত বিশেষ, সেহেতু এ দু’টি কখনও পরস্পর বিরোধী হতে পারে না। বাস্তবেও তা ঘটে নি।
টেলিভিশন স্ক্রিনে ইসলামিক লেকচার শুনা জায়েজ কিনা?
রাসুল (সাঃ) কে দেয়ালে দৃশ্য পটে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখিয়েছেন আল্লাহ! আবার আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাস রাসুল (সাঃ) কে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন স্ক্রিনের মত করে !
এখন কিয়াস হচ্ছে কানেক্টিভিটি। এর প্রেক্ষিতে স্ক্রিনে ইসলামিক প্রোগ্রাম জায়েজ। সংবাদ পরিবেশন জায়েজ। এটাই কিয়াস। একইভাবে স্ক্রিন নাজায়েজ কাজে ব্যবহার নিষেধ যেমন নাটক, নাচ, গান !
ওপেন হার্ট সার্জারীর জন্য ঝুকি নেয়া কি জায়েজ? কুরআন সুন্নায় এর উদাহরণ আছে কিনা? রাসুল (সাঃ) কে প্রায় তিনবার বুক চিরে হার্ট পরিস্কার করা হয়েছে।
এখন কিয়াস হচ্ছে কানেক্টিভিটি। ১৪৫০ বছর আগের কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বর্তমান সময়ের সমস্যার সমন্বয় ভিত্তিক সমাধান। কিয়াস হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জারী করা যাবে! রাসুল (সাঃ) এর জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে আদর্শ।
এটাই হচ্ছে কিয়াস। অর্থাত কুরআন ও হাদিসের বাইরে নয়।
আল্লাহর কুরআনের কোনো আয়াত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো সহিহ হাদিস বিজ্ঞানে-পরীক্ষিত কোনো ধ্রুবসত্যের বিরোধী হয়েছে— এমন কোনো প্রমাণ আজও কেউ দিতে পারে নি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোনো কোনো থিওরি প্রাথমিকভাবে আল-কুরআন ও সহিহ হাদিসের সাথে বিরোধী হয়েছে এমন মনে হয়ে থাকে, তথাপি সেখানে আল্লাহর কুরআন ও সহিহ হাদিসই মূলত গ্রহণযোগ্য হবে, কারণ এ সমস্ত প্রাথমিক থিওরি (যা পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি তা) পরিবর্তনশীল। আল্লাহর কুরআনের কোনো আয়াত, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সহিহ হাদিস পরিবর্তনশীল নয়। হাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে অনেকেই সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে দরকার প্রকৃত জ্ঞানীর কাছে ফিরে যাওয়া।
বিশেষ কৃতজ্ঞতায়:
১. ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
২. ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
৩. Islam House . com
৪. শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
৫. শায়খ মুফতী কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম
ইজমা ও কিয়াস নিয়ে আমাদের সমাজে ব্যপক ভুল ধারণা বিদ্যমান। আমরা জানিই না ইজমা কি আর কিয়াস কি!
মানুষ ইজমা কিয়াস সম্পর্কে মারাত্মক ভুল জ্ঞান রাখার কারণে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় ধর্মের মধ্যে ইজমা কিয়াসের নাম দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিদাতি খুবই অল্প জ্ঞানী সুফিবাদী আলেম নাম ধারী লোকেরা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের কাছে নতুন নতুন বিষয় উপস্থাপন করে বলেন এটা ইজমা হয়ে গিয়েছে ওটা কিয়াস হয়ে গিয়েছে। আর সাধারণ মানুষও না বুঝেই সেগুলো গ্রহণ করেছে এবং সহিহ বিষয় উপস্থাপন হলে উনারা সেটা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইজমা কিয়াসের যুক্তি দাড় করান অথচ তিনি জানেনই না ইজমা কি বা কিয়াস কি!
আল্লাহ্ সুবহানওয়া বলেন:
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (মায়েদা, ৫ : ৩);
‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর ।’ (নিসা, আয়াত ৫৯);
'সে লোক ইমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে [রাসুল স] ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে ।’ (নিসা, আয়াত ৬৫)
আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসুলের (ইমরান, আয়াত ৩২, ১৩২; নিসা, আয়াত ৫৯; আনফাল, আয়াত ১, ২০, ৪৬; নুর, আয়াত ৫৪, ৫৬; মুহাম্মদ, আয়াত ৩৩; মুজাদালাহ, আয়াত ১৩; আততাগাবুন, আয়াত ১২);
'তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তাঁর অনুসরণ করো এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অলী আওলীয়াদের অনুসরণ করো না । তোমরা অল্প সংখ্যক লোকই তা স্মরণ রাখো ।’ (আ’রাফ, আয়াত ৩)
অনেকেই বলে থাকেন কুরআন হাদিসে সমাধান না পাওয়া গেলে কি করব? অথচ স্বয়ং আল্লাহ বলছেন মতানৈক্য হলে রাসুল (সাঃ) ও কুরানের দিকে ফিরে আসতে! অর্থাত কুরআন ও হাদিসের মধ্যেই সমাধান অবশ্যই আছে। তারপরেও যদি বলেন কুরানে ও হাদিসে তো নাই! তাহলে তো আরো সহজ যা কুরআন ও হাদিসে নাই তা ইসলামেও নাই!
‘‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’’ -(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস নং ১৫৬০, হাদীসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে)
ইসলামী শরীয়তের (আইনের) তৃতীয় উৎস হলো ইজমাঃ
——————————————————
ইজমা হলো এ উম্মতের দীনি জ্ঞানসম্পন্ন মুজতাহিদদের ঐকমত্য পোষণ।
আর এর ভিত্তি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহিহ হাদিস- '‘আমার উম্মত কখনও ভ্রষ্ট পথে একমত হবে না’’ । (মুস্তাদরাকে হাকিম (১/২০০-২০১) হাদীস নং- ৩৯৪, ৩৯৬, ৩৯৭, ৩৯৯, ৪০০। আরো দেখুন: আবুদাউদ (৪/৯৮) হাদীস নং- ৪২৫৩; তিরমিজি (৪/৪৬৬) হাদীস নং- ২১৬৭; ইবনে মাজা (২/১৩০৩) হাদীস নং- ৩৯৫০)
সুতরাং উম্মতের সবাই যদি কোনো ব্যাপারে একমত হয়, তাহলে তাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুমতিক্রমেই হবে। আর তা হবে গ্রহণযোগ্য। পূর্ববর্তী কোনো দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদের নবীর মুখ থেকে এরকম কোনো অভয়বাণী শোনানো হয় নি। ফলে তাদের সবাই একমত হলেই সে মতটি সঠিক হওয়ার গ্যারান্টি নেই।
আজকে সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে সহজে বুঝা যায় যে আহলে সুন্নাত জামায়াতের স্কলারগণ অন্যান্য প্রচলিত বিভিন্ন ফেরকার নিজস্ব মতামত গ্রহণ করছেন না। তারা কুরআন ও সহিহ হাদিসের বাইরে কোনো মতামত গ্রহণ করেন না। ব্যক্তিগত কোনো মতামত তারা গ্রহণ করেন না। অতএব ইজমা ইজমা করে যারা নতুন বিষয় দ্বীনে প্রবেশ করাচ্ছেন তারা মূলত ইজমা নিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন।
আজকে সমাজে কিছু সংখ্যক আলেম ইজমা ইজমা করছেন অথচ সালাফি স্কলারগণ রীতিমত তাদের বিরোধিতা করছেন! তাহলে ইজমা হলো কিভাবে?
“যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
অনেক স্কলারদের মতে চার খলিফার পরে উম্মতের মধ্যে ইজমা হওয়ার আর কোনো সুযোগ নাই! ইজমার উদাহরণ হচ্ছে যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পাচ ওয়াক্ত ১৭ রাকাত সালাত ফরজ। এই ফরজ কম করা যাবে না বা বেশিও করা যাবে না। এটাই হচ্ছে ইজমা। কেউ যদি বলে ১৭ রাকাত না ১৮ রাকাত বা ১৯ রাকাত তবে তা গ্রহণ যোগ্য হবে না!
এটাই ইজমা যে ১৭ রাকাত ফরজ সালাত। এটা ১৪৫০ বছর আগে থেকেই প্রকাশিত একটা বিষয়। নতুন বিষয় নয়। কেউ যদি বলে বিতর সালাত ফরজ এটা ইজমা তাহলে এটা ভুল! ফরজ তো অবশ্যই নয়। বিতর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা অর্থাত খুব গুরুত্ত পূর্ণ ঠিক যেমন ফজরের সুন্নত সালাত খুব গুরুত্ব পূর্ণ, যদিও কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন! তবে অধিকাংশ স্কলারদের মতে এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
লক্ষনীয় বিষয় কেউ যদি বলে বিতর ফরজ বা ওয়াজিব এটা ইজমা তাহলে ভুল! উপরের হাদিস লক্ষ্য করেন ”একমত হবে না” অর্থাত অধিকাংশ স্কলার সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন যদিও কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন।
কিন্তু সবাই একমত দৈনিক পাচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ। চার ওয়াক্ত নয় আবার ছয় ওয়াক্তও নয়। এটাই ইজমা।
যাকাত ফরজ এটা ইজমা।
সিয়াম ফরজ এটা ইজমা।
ইসলামী শরীয়তের (আইনের) চতুর্থ উৎস হলো কিয়াস:
—————————————————-
যা নির্ভর করে পূর্ববর্তী তিনটি উৎসের উপর। সুতরাং এটাও মনগড়া কিছু নয়। কিয়াস হচ্ছে কুরআন ও হাদিসকে কেয়ামত পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করা। এটা নতুন কোনো বানানো বিষয় নয়।
এর ছোট্ট একটা উদাহরণ হলো এই কাগজে কুরআন লেখা কি নিষেধ? এখানে কিয়াস হচ্ছে অবশ্যই না। কারণ তত্কালীন সময়ে চামড়ায় গাছের পাতায় বাকলে লেখা হত , যদি কাগজ থাকত তবে কাগজেও লেখা হত।
এই যে ১৪৫০ বছর আগে নাজিল হওয়া কুরআনের বিধান বর্তমান সময়ে সমন্বয় করা এটাই কিয়াস।
বিলাল (রাঃ) কে উচ্চ স্বরে আজান দিতে বলা হত যাতে বেশি দূর পর্যন্ত লোকে আজান শুনতে পায়!। এবং এক অন্ধ লোককে আজান শুনতে পেলে মসজিদে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল । আজান যত বেশি দূর পর্যন্ত পৌছবে তত সয়াব অর্জনের কথা হাদিসে এসেছে। ইসলাম জীবনের প্রয়োজনে নতুন টেকনোলজি ব্যবহার নিষেধ করে না। অতএব বুঝা যাচ্ছে যদি তখন মাইক থাকত তাহলে মাইক ব্যবহার করা হত। মাইক ব্যবহার দ্বীন ইসলামের বিধান পরিবর্তন করে না।
“যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে উহার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে উহার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না”। (মুসলিম)
এই যে সংযোজন অর্থাত কানেক্টিভিটি ১৪৫০ বছর আগের কুরআন ও হাদিসের বাণীর সাথে এটাই হচ্ছে কিয়াস।
অথচ সমাজে দ্বীনের নাম নতুন বিষয় সংযোজন করে বলা হচ্ছে এটা কিয়াস! অথচ দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নতুন সংযোজন বিদাত যা গোমরাহী যার পরিনাম জাহান্নাম।
উদাহরণস্বরূপ:
কিয়াসের নামে কুরআন ও সুন্নাহের বিপরীত কোনো বিষয় গ্রহণ করা কিভাবে সমীচীন হবে?
“যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
একই ভাবে বাসে চড়া বিমানে চড়া, মেশিনে কাপড় সেলাই জায়েজ কিনা , মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা জায়েজ কিনা এগুলো সম্পর্কে মাসাআলা কিয়াসের ভিত্তিতে হয়।
কিন্তু দ্বীন ইসলামের কোনো বিষয়ই হের ফের করার সুযোগ নেই।
অতএব আমরা বুঝতে পারছি যে, ইসলাম এমন একটি দ্বীনের নাম, যা সম্পূর্ণভাবে অবিকৃত রয়েছে। আর তার বিধানসমূহে বাইরের কোনো প্রভাব সেখানে পড়ে নি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলাই এ বিধান দিয়েছেন, আর জ্ঞান-বিজ্ঞানও তাঁর পক্ষ থেকেই দেয়া নেয়ামত বিশেষ, সেহেতু এ দু’টি কখনও পরস্পর বিরোধী হতে পারে না। বাস্তবেও তা ঘটে নি।
টেলিভিশন স্ক্রিনে ইসলামিক লেকচার শুনা জায়েজ কিনা?
রাসুল (সাঃ) কে দেয়ালে দৃশ্য পটে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখিয়েছেন আল্লাহ! আবার আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাস রাসুল (সাঃ) কে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন স্ক্রিনের মত করে !
এখন কিয়াস হচ্ছে কানেক্টিভিটি। এর প্রেক্ষিতে স্ক্রিনে ইসলামিক প্রোগ্রাম জায়েজ। সংবাদ পরিবেশন জায়েজ। এটাই কিয়াস। একইভাবে স্ক্রিন নাজায়েজ কাজে ব্যবহার নিষেধ যেমন নাটক, নাচ, গান !
ওপেন হার্ট সার্জারীর জন্য ঝুকি নেয়া কি জায়েজ? কুরআন সুন্নায় এর উদাহরণ আছে কিনা? রাসুল (সাঃ) কে প্রায় তিনবার বুক চিরে হার্ট পরিস্কার করা হয়েছে।
এখন কিয়াস হচ্ছে কানেক্টিভিটি। ১৪৫০ বছর আগের কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বর্তমান সময়ের সমস্যার সমন্বয় ভিত্তিক সমাধান। কিয়াস হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জারী করা যাবে! রাসুল (সাঃ) এর জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে আদর্শ।
এটাই হচ্ছে কিয়াস। অর্থাত কুরআন ও হাদিসের বাইরে নয়।
আল্লাহর কুরআনের কোনো আয়াত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো সহিহ হাদিস বিজ্ঞানে-পরীক্ষিত কোনো ধ্রুবসত্যের বিরোধী হয়েছে— এমন কোনো প্রমাণ আজও কেউ দিতে পারে নি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোনো কোনো থিওরি প্রাথমিকভাবে আল-কুরআন ও সহিহ হাদিসের সাথে বিরোধী হয়েছে এমন মনে হয়ে থাকে, তথাপি সেখানে আল্লাহর কুরআন ও সহিহ হাদিসই মূলত গ্রহণযোগ্য হবে, কারণ এ সমস্ত প্রাথমিক থিওরি (যা পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি তা) পরিবর্তনশীল। আল্লাহর কুরআনের কোনো আয়াত, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সহিহ হাদিস পরিবর্তনশীল নয়। হাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে অনেকেই সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে দরকার প্রকৃত জ্ঞানীর কাছে ফিরে যাওয়া।
বিশেষ কৃতজ্ঞতায়:
১. ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
২. ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
৩. Islam House . com
৪. শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
৫. শায়খ মুফতী কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম