Sunday 13 September 2015

ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব অনুযায়ী ধারাবাহিকতা

●●প্রয়োজনীয় পোস্ট. আসুন পড়ে দেখি●●
দ্বীনের ইলম অর্জন ফরয, এটা আমরা সবাই জানি কিন্তু ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আছে যা সবার আগে জানতে হয়, আবার কিছু বিষয় ধীরে ধীরে জেনে নিলেও হয়। আসুন এ বিষয়ের উপর রচিত এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি পড়ে দেখি, জেনে নিই,
কোন বিষয়গুলো আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জেনে নিব>>
ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব অনুযায়ী ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
________________________________________
এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক (রঃ) কে জিজ্ঞেস করলোঃ হে আবু আব্দুর রহমান, কোনটাকে আমি সারাদিনে বেশী প্রাধান্য দিবোঃ আল-কোরআন শিক্ষা না ইলম শিক্ষা? তিনি বললেনঃ তুমি কি এমন পরিমাণ আল-কোরআন শিখেছো যা দিয়ে তুমি সুন্দরভাবে সালাত কায়েম করতে পারো। সে বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে তোমার জন্য ইলম। (ইবনে মুফলিহ রচিত “আল আদাব আশ শারীয়াহ” ২/৩৩-৩৪)
অর্থাৎ ইলম অর্জনের মধ্যেও গুরুত্বের কারণে আগে পরে শিক্ষা করার ব্যাপার আছে। সম্পূর্ণ আল-কোরআন শিক্ষা করা একটি নফল ইবাদাত কিন্তু দ্বীনের কোন কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। সালাত কায়েম করার পরিমাণ আল-কোরআন শিক্ষার পর অন্যান্য ইলম যেগুলি ফরজ সেগুলি শিক্ষা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
ইবনে মুফলিফ “আল আদাব আশ শারীয়াহ” (২/৩৩-৩৪) গ্রন্থে আবু হারিস এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেছেনঃ “তার উপর আবশ্যকীয় হলো এমন জ্ঞান অর্জন করা যার উপর দ্বীন প্রতিষ্টিত এবং যা পরিত্যাগ করা (abandon) তার উচিত নয়”। আমি বললামঃ দ্বীন তো সকল জ্ঞানের উপর প্রতিষ্টিত। তিনি বললেনঃ “ফরজ যেগুলি তার উপর ব্যক্তিগতভাবে বাধ্যতামূলক এসব ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনের ফরজ হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই”।
ইবনে রজব (রঃ) বলেছেনঃ
নিশ্চয়ই প্রত্যকে মুসলিমের উপর দ্বীনের ঐ সকল ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন ফরজ – যেগুলি তার প্রয়োজন। যেমনঃ পবিত্রতা, সালাত, সিয়াম। আর যার সম্পদ আছে তার জন্য ঐ জ্ঞান অর্জন ফরজ যা ঐ সম্পদের কারণে তার উপর দায়িত্ব বর্তায় যেমনঃ যাকাত, সদকা, হাজ্জ্ব এবং জিহাদ। এ কারণে যারা বেচা-কেনা করেন, তাদের জন্য ক্রয়-বিক্রয়ে হালাল-হারাম শিক্ষা করা ফরজ। (দেখুনঃ মাজমু আর-রাসাইল, অধ্যায়ঃ ‘ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া, শারহু হাদিস আবি দারদা’, পৃঃ ২২-২৩)
অর্থাৎ ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ধারাবাহিকতা আছে। সবার আগে ঐ সব ব্যাপারে ইলম অর্জন করা ফরজ যা নিজে ফরজ। তারপর ঐ সব বিষয় আসবে যা নিজে সুন্নাহ ও মুস্তাহাব। আর সমস্ত ফরজের মধ্যে জীবনে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর বাস্তবায়ন তথা তাগুতকে অস্বীকার করা ও তাওহীদের বাস্তবায়ন, শিরক-কুফর পরিত্যাগ সবার আগে আসে। এসব বিষয় শিক্ষা করার আগে শারীয়াতের অন্যান্য সুন্নাহ ও মুস্তাহাব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা – যথাযথ ধারাবাহিকতার পরিচায়ক নয় বরং অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে।
অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়ঃ বিচার দিবসে সমস্ত মানবজাতি মোট তিনটি ভাগে ভাগ হবে।
ক) অনেকে চির-জাহান্নামী হবে। যেমনঃ কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও মুর্তাদগণ।
খ) অনেকে সাময়িক সময়ের জন্য জাহান্নামে যাবে। যেমনঃ ফাসিক মুসলিমগণ যাদের তাওবা কবুল হয় নি কিংবা শাফায়াতও করা হয় নি কিংবা আল্লাহ নিজে থেকেও মাফ করে দেন নি।
গ) অনেকে আল্লাহর রহমতে সরাসরি জান্নাতে যাবে। কেউ কেউ জান্নাতের উচ্চস্তরে যাবে, কেউবা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে।
‘আগে মূলধন রক্ষা, পরে লাভ করার চেষ্টা’ - ইসলামের এই মূলনীতির আলোকে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলেঃ
ক) সবচেয়ে আগে আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা চির-জাহান্নামী না হই।
খ) তারপর চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদেরকে বিন্দুমাত্র সময়ের জন্যও জাহান্নামে না যেতে হয়।
গ) তারপর চেষ্টা করতে হবে যাতে জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যাওয়া যায়।
ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের এই পর্যায়ক্রমিক ধারা মনে রাখা উচিত।
১) চিরস্থায়ী ভাবে জাহান্নামে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলে, আমাদেরকে মুসলিম হতে হবে আর মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হবে।
এর জন্য যা যা নূন্যতম প্রয়োজন তা হলোঃ
(ক) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ এই সাক্ষ্য দেয়া – যা ইসলামের প্রথম স্তম্ভ। অর্থাৎ আমি সকল প্রকার মিথ্যা ইলাহ (তাগুত), মিথ্যা মাবুদ, ইবাদাতের মিথ্যা দাবীদার, অনুসরণের মিথ্যা দাবীদার, অনুকরণের মিথ্যা দাবীদারকে অস্বীকার করে, পরিত্যাগ করে, সেসব মিথ্যা ইলাহদের সাথে শত্রুতা পোষন করে, তাদেরকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করছি। আর আল্লাহর সকল নাম ও গুনাবলী, তাঁর কাজসমূহ, তাঁর ইবাদাত, তাঁর হুকুম-আহকামে তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে অন্তরে, কথায় ও কাজে মেনে নিচ্ছি।
- এখন ‘লা ইলাহা’ – অর্থ কি?
- কি (বস্তু কিংবা মতবাদ) এবং কারা সেই মিথ্যা ইলাহ - এটা না জানলে কি এসব মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার করা যাবে?
- এই মিথ্যা ইলাহদেরকে কিভাবে অস্বীকার করতে হবে?
- শুধু মুখের মাধ্যমে অস্বীকার করাই কি যথেষ্ট?
- সবগুলি মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার করে, শুধুমাত্র যে কোন একটি মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার না করলে, পরিত্যাগ না করলে কি মুসলিম হওয়া যাবে?
এই ব্যাপারগুলি প্রথমেই আমাদেরকে জানতে হবে।
- আবার ‘ইল্লাল্লাহ’ – অর্থ কি?
- আল্লাহ কোন কোন ক্ষেত্রে এক ও অদ্বিতীয়?
- রব হিসেবে আল্লাহর কাজ, যেগুলিতে তিনি এক ও অদ্বিতীয় যেমনঃ সৃস্টি করা, রিযিক দান, বিপদ থেকে উদ্ধার করা, আইন-প্রণয়ণ, বিচার-ফায়সালা, মৃত্যু দান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনে কিভাবে আল্লাহর একত্ববাদ বজায় রাখতে হয়?
- বাস্তব জীবনে মানুষ কিভাবে আল্লাহর কাজ, তাঁর নাম ও গুনাবলীতে, তাঁর ইবাদাতে একত্ববাদ বিরোধী কাজ করছে বা শিরক করছে?
- ইবাদাতের ক্ষেত্রে কিভাবে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় মানতে হয়?
- ‘ইবাদাত’ কাকে বলে? শুধু কি সালাত- সিয়াম এগুলিই ইবাদাত?
এই ব্যাপারগুলিও আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে।
- ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ – বলতে কি বুঝায়?
- রসুল কাকে বলে? রসুলের দায়িত্ব কি ছিলো?
- তিনি কি কিছু জ্ঞান প্রকাশ্য জানিয়ে, বাকীটুকু গোপন রাখতে পারেন?
- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাস্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে, বিচার-ফায়সালার ক্ষেত্রে রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো আইন-নিয়ম-শিক্ষা থেকে অন্য কোন মহাপুরুষ-বুদ্ধিজীবি-দার্শনিকের যেমনঃ এরিস্টেটল-প্লেটো-মাও সেতুং- লেলিন-স্টেলিন-আব্রাহাম লিংকন কিংবা এ জাতীয় আরো অনেকের শিখানো আইন-নিয়ম-শিক্ষাকে উত্তম মনে করলে, সেগুলির প্রচার-প্রসার করলে, সেগুলি দিয়ে নিজ দেশ-সমাজকে পরিচালিত করতে চাইলে কি নবীকে উত্তম আদর্শ মানা হয়?
- সে ক্ষেত্রে কি মুসলিম থাকা যায়?
- ইবাদাতের ক্ষেত্রে নাবীর সুন্নাতের বাইরে গিয়ে বিদয়াতে লিপ্ত হলে কিভাবে সেটা স্ববিরোধিতা হয়?
এই ব্যাপারগুলিও আমাদেরকে জানতে হবে।
ইসলামের ২য় স্তম্ভ সালাতের যেভাবে কিছু পূর্বশর্ত আছে, যেগুলির যেকোন একটি পালন না করলেও সালাত আদায় হয়না, যেমনঃ ওযু করা কিংবা শরীর পবিত্র থাকা; সেভাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর কোন পূর্বশর্ত কি আছে? সেগুলি কি কি?
ঠিক যেভাবে কোন কোন কাজ করলে ওযু নষ্ট হয়, সালাত নষ্ট হয়, পুনরায় নতুনভাবে ওযু করতে হয়, সালাত আদায় করতে হয়; সেভাবে কি কি কাজ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়?
- ঈমান নষ্টকারী কাজের মধ্যে বড় শিরক, বড় কুফর, বড় নিফাকী কি কি কাজে হয়?
- কিভাবে আমাদের সমাজে মানুষ না জেনেই এসব কাজে জড়িত হচ্ছে?
- এছাড়া ‘রিদ্দা’ বা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণসমূহ আমাদেরকে জানতে হবে – যাতে আমরা ইসলাম গ্রহন করার পর আবার কাফির-মুরতাদে পরিণত না হই।
এই ব্যাপারগুলি সবই সর্বপ্রথম জানার বিষয়। কারণ শিরকে লিপ্ত থাকলে অন্য কোন ইবাদাত কবুল হয় না। বড় কুফরে লিপ্ত থাকলে তো মুসলিমই থাকা যাচ্ছে না।
এ রকম যেসব ইলমের উপর নির্ভর করে আমাদের মুসলিম থাকা কিংবা না থাকা – এসব জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক জ্ঞান। এই ব্যাপারগুলি আমাদেরকে সবচেয়ে আগে, সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে, সবচেয়ে বেশী সময় নিয়ে অধ্যয়ন করা উচিত, আলিমদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয়া উচিত।
এখন কোন আলিম সারা-জীবনে কখনো এসব মৌলিক ব্যাপারে আলোচনা না করে থাকলে, তাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ - কেন তিনি আমাদেরকে এসব গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান থেকে এতদিন দূরে রেখেছেন? আমাদেরকে এসব বিষয় না জানিয়ে আমাদেরকে বিপদ-সীমায় ফেলে রেখেছেন?
২) সাময়িক সময়ের জন্যও জাহান্নামে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলেঃ
আমাদেরকে উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করার পর -
(ক) অন্যান্য সকল হারাম এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। যেমনঃ সুদ দেয়া, নেয়া, সুদের লেখক হওয়া বা সাক্ষী হওয়া ইত্যাদি।
- এখন এ রকম কবিরা গুনাহগুলো কি কি? - তা আমাদেরকে জানতে হবে?
- বাস্তবে কিভাবে মানুষ এসব গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে? – তা জানতে হবে। যেমনঃ সুদের ক্ষেত্রে সুদ ভিত্তিক লোন নেয়া, লোন দেয়া, ফিক্সড ডিপোজিট রাখা, সুদ ভিত্তিক ব্যাংকে চাকুরী করা ইত্যাদি ব্যাপার সমূহ।
(খ) সকল ফরজ-ওয়াজিব সমূহ পালন করতে হবে। তাই কি কি কাজ একজন মুসলিমের উপর ব্যক্তিগতভাবে ফরজ আর কি কি কাজ সামষ্টিকভাবে ফরজ, তা জানতে হবে। যেমনঃ ইলম অর্জন, সালাত প্রতিষ্ঠা, যাকাত প্রদান, সিয়াম সাধনা, দাওয়াত, সৎ কাজের আদেশ-অসৎ কাজে নিষেধ, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ কিংবা পারিবারিক-সামাজিক যে সব দায়িত্ব আমাদের উপর ফরজ ইত্যাদি।
৩) জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যেতে হলেঃ
উপরে উল্লেখিত উভয় বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করার পর -
আমাদেরকে অন্যান্য নফল ইবাদাত সমূহ যেমনঃ আল-কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, নফল সিয়াম, নফল সালাতসমূহ আদায়, দান-সদকা ইত্যাদি ব্যাপারে অনেক বেশী মনযোগী হতে হবে।
বাস্তবে দেখা যায়, আমরা সবাই “সাময়িক সময়ের জন্যও জাহান্নামে না যাওয়া” এবং “জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যাওয়ার” জন্য প্রয়োজনীয় ইলম নিয়ে মহাব্যস্ত কিন্তু “চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া থেকে বাঁচার ইলম” নিয়ে কোন চিন্তা নেই!!!
পুরো ব্যাপারটি সাধারণ মুসলিমদের জন্য নিছক বোকামী ও দূরদর্শীতার অভাব আর কোন কোন আলিমের অজ্ঞতা, কারো কারো ইমামতি হারানোর ভয়, কারো সত্য গোপন করা এবং আরো অনেকের দুনিয়ার সম্পদের লোভ - ছাড়া আর কিছু না!!!
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার অনুযায়ী ইলম অর্জন করার তৌফিক দান করুন।

No comments:

Post a Comment